হযরত খাদিজা রা. - এর জীবনী

হযরত খাদিজা রা. - এর জীবনী

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম স্ত্রী হযরত খাদীজা (রা)। তাঁর ডাকনাম ‘উম্মু হিন্দা’ ও উম্মুল কাসিম’ এবং উপাধি বা লকব ‘তাহিরা’। পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ মক্কার কুরাইশ খান্দানের বনু আসাদ শাখার সন্তান। পিতৃবংশের উর্ধ্বপুরুষ ‘কুসাঈ’-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নসবের সাথেতাঁর নসব মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ খাদীজা বিনতে খুলয়াইলিদ ইবন আসাদ ইবন ‘আবদুল ‘উয্যা ইবন কুসাঈ। এই ‘কুসাঈ রাসূলুল্লাহরও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৪র্থ ঊধ্বতন পুরুষ। হযরত খাদীজার (রা) মাতা ফাতিমা বিনতে যায়িদও ছিলেন কুরাইশ বংশীয়া। যুবাইর ইবন বাক্কার বলেনঃ জাহিলী যুগেই খাদীজার লকব ছিল ‘আত-তাহিরা’। বয়স ও বুদ্ধি হওয়ার পর পুতঃপবিত্র চরিত্রের জন্য এ লকব পান। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও হযরত খাদীজার (রা) মধ্যে ফুফু-ভাতিজার দূর সম্পর্ক ছিল। এ কারণে, নবুওয়াত লাভের পর হযরত খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাচাতো ভাই য়ারাকা ইবন নাওফিলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। সম্ভবত বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি একথা বলেছিলেন।


হযরত খাদীজার (রা) পরিবারটি ছিল মক্কার এক অভিজাত ও বিত্তবান পরিবার। তাঁর জন্ম হয় ‘আমুল ফীল’ (হাতীর বছর)-এর ১৫ বছর পূর্বে, মুতাবিক হিঃপৃঃ ৬৮/খ্রীঃ ৫৫৬ সনে মক্কা নগরীতে। হাকীম ইবন হিযাম বলেন, আমার ফুফু খাদীজা আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আমার জন্ম হাতীর বছরের তোরো বছর আগে।


হযরত খাদীজার (রা) পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ নিজ খান্দানের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মক্কায় এসে চাচাতো ভাই ‘আবদুদ দার ইবন কুসাঈ-এর হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্থায়অ আবাস গড়ে তোলেন। এখানেই মক্কার মেয়ে ফাতিমা বিন্ত যায়িদকে বিয়ে করেন। এই ফাতিমা উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার জননী। খুওয়াইলিদ ছিলেন ফিজার যুদ্ধে নিজ গোত্রের কমান্ডার। তিনি ছিলেন বহু সন্তানের জনক। প্রথম পুত্র হিযাম, এই হিযামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হাকীম জাহিলী যুগে মক্কার দারুন নাদওয়া’র পরিচালনভার লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান খাদীজা (রা)। তৃতীয় সন্তান ‘আওয়াম প্রখ্যকাত সাহাবী হযরত যুবাইরের (রা) পিতা। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফুফু এবং হযরত হামযার (রা) আপন বোন হযরত সাফিয়্যা বিনত ‘আবদিল মুতাতইলব ছিলেন আওয়ামের স্ত্রী তথা যুবাইরের (রা) মা। অর্থাৎ খাদীজার (রা) ছোট ভাই-বউ। চতুর্থ সন্তান হালা। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেয়ে হযরত যায়নাবের (রা) শ্বাশুড়ী, তথা আবুল ‘আস ইবন রাবী’র মা। আবুল ‘আস রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া। তাছাড়া, বালাজুরী খালিজা ও রাকীকা নাম্নী তাঁর আরও দুই মেয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। খঅলিদার বিয়ে হয় ‘ইলাজ ইবন আবী সালামার সাথে, আর রাকীকার বিয়ে হয় ‘আবদুল্লাহ ইবন বিজাদের সাথে। হযরত খাদীজার (রা) ভাই-বোনদের মধ্যে একমাত্র হালা (রা) ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন।


হযরত খাদীজার (রা) বাল্য ও কৈশোর জীবনের তেমন কোনতথ্য সীরাতের গ্রন্থাবলীতে পাওয়া যায় না। তবে সেই জাহিলা সমাজে তিনি যে অতি পুতঃপবিত্র স্বভাব-বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন সে কথা বিভিন্নভাবে জানা যায়। পিতা খুওয়াইলিদ মেয়ের এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে তৎকালীন আরবের বিশিষ্ট্য তাওরাত ও ইনজীল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নাওফিলকে তাঁর বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে সে বিয়ে হয়নি সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নীরব। শেষ পর্যন্ত আবু হালা হিন্দা ইবন যুরারা আত-তামীমীর সাথে থ৭ার প্রথম বিয়ে হয়।াজহিলা যুগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু হালার মৃত্যুর পর আতীক ইবন আবিদ, মতান্তরে আয়িজ-এর সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এ কথা বলেছেন ইবন ‘আবদিল বারসহ অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞ। তবে কাতাদার সূত্রে জানা যায়, তাঁর প্রথম স্বামী ‘আতীক, অতঃপর আবু হালা। ইবল ইসহাকও এ মত পোষণ করেছেন বলে ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেছেন। বালাজুরী বলেছেন, দ্বিতীয় স্বামী ‘আতীকের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তাপর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিয়ে করেন।


হযরত খাদীজার (রা) পিতা কখন মারা যান, সে সম্পর্কে সীরাতের গ্রন্থাবলীতে দুই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তাঁর বিয়ের সময় পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন এবং বিয়ের পর কোন এক সময় মারা যান। কেউ কেউ বলেছেন ফিজার যুদ্ধে তিনি মারা যান। ঐতিহাসিক আল-ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন, খাদীজার (রা) পিতা ফিজার যুদ্ধের পূর্বে মারা যান এবং তাঁর চাচা ‘আমর ইবন আসাদ তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ে দেন। তিনি আরও বলেছেন, ফিজারের পূর্বে যে তাঁর পিতা মারা যান সে ব্যাপারে আমারদের সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে ইজমা রয়েছে। কোন দ্বিমত নেই। ইমাম সুহায়লীও একথা বরেছেন।


পিতার মৃত্যু বা স্বামী থেকে বিচ্ছিন্নতা বা অন্য যে কোন কারণেই হোক, কুরাইশ বংশের অনেকের মত হযরত খাদীজাও (রা) ছিলেন একজন মস্তবড় ব্যবসায়ী। ইবন সা’দ তাঁর ব্যবসা সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘খাদীজা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা। তাঁর বাণিজ্য সম্ভার সিরিয়া যেত এবং তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সকলের পণ্যের সমান হতো।’ ইবন সাহদেব এ মস্তব্য দ্বারা হযরত খাদীজার (রা) ব্যসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা যায়। অংশীদারী বা মজুরীর বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ-বিদেশে মাল কেনাবেচা করতেন।


মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন চবিবশ-পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সাথে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যবসায়ে তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথাও মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সবার কাছে তিনি তখন ‘আল-আমীন’। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার (রা) কানেও পৌঁছেছে। বিশেষতঃ তার ছোট ভাই-বউ সাফিয্যার কাছে ‘আল আমীন’ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে বহু কথাই শুনে থাকবেন।


এ সময় হযরত খাদীজা (রা) সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার চিন্তা করলেন। এজনব্য যোগ্য লোকের সন্ধান করছেন। অবশেষে মুহাম্মদ ইবন ‘আবদিল্লাহকে নিয়োগ দান করেন। যেভাবে তিনি নিয়োগ রাভ করেন, সে সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা আমরা এখানে তুলে ধরছি।


হযরত ইয়া’লার বোন নাফীসা বিন্ত মুনইয়া বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন পঁচিশ বছরে পদার্থণ করেছেন, তখন আবু তালিব একদিন ত৭াকে ডেকে বললেনঃ ‘ভাতিজা! আমি একজন বিত্তহীন মানুষ, সময়টাও আমাদের জন্য খুব সন্কটজনক। মারাত্মক অভাবের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোন ব্যবসা বা অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাচে। খাদীজা তার পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হযতো তোমাকে সে নির্বাচন করতো, তোমার চারিত্রিক নিস্কুলুষতা তার জানা আছে। যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশস্কা করি। বতুও এমনিটি না করে উপায় নেই। জবাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সম্ভবতঃ সে নিজেই লোক পাঠাবে। আবু তালিব বললেনঃ হয়তো অন্য কাউকে সে নিয়োগ দিয়ে ফেলবে। চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট লোক পাঠিয়ে বললেনঃ অন্য লোকের আপনাকে যে পারিশ্রমিক দিবে, আমি তার দ্বিগুণ দিব।


বালাজুরী বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স যখন বিশ বছর তখন আবু তালিক একদিন বললেনঃ ভাতিজা! খাদীজা বিনত খুওয়াইলিক একজন ধনবতী ব্যবসায়ী মহিলা। তার এখন প্রেয়োজন তোমার মত একজন সৎ, বিশ্বস্ত ও চরিত্রবান লোকের। আমি যদি তোমার ব্যাপারে কথা বলি, হয়তো সে তার কোন ব্যবসায়ে তোমাকে দায়িত্ব দিতে পারে। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ চাচা! আপনি যা ভালো মনে করেন, করুন।


আবু তালিব খাদীজার নিকট গেলেন এবং তাঁর কোন ব্যবসায় মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়োগর ব্যাপারে কথা বললেন। খাদীজা প্রস্তাব শুনে আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে সিরিয়া পাঠিয়ে দিলেন।


‘আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন ‘আকীল বলেছেনঃ আবু তালিক মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ভাতিজা! শুনেছি খাদীজা অমুককে দুইটি জওয়ান উটের বিনিময়ে মজুর হিসেবে নিয়োগ করেছে। তোমার ব্যাপারে আমরা এতে রাজি হবো না। তুমি তার সাথে কথা বলতে চাও? বললেনঃ চাচা আপনি যা ভালো মনে করেন। এরপর আবু তালিক খাদীজার নিকট যেতে বলেনঃ খাদীজা! তুমি কি মুহাম্মদকে মজুরীর বিনিময়ে নিয়োগ করতে চাও? শুনেছি তুমি অমুককে দুইটি জাওয়ান উটের বিনিময়ে নিয়োগ করেছো। মুহাম্মদের ব্যাপারে চার উটের কমে আমরা রাজি হবো না।


উল্লেখিত বর্ণনাগুলি দ্বারা বুঝা যায়, হয়রত খাদীজা (রা) একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসা পরিচালনার জন্য তিনি বহু শ্রমিক কর্মচারী নেয়াগ করতেন। তাঁর বৃদ্ধিও ছিল প্রখর। তাই তিনি যথাসময়ে মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্বাচনে এবং তাঁর উপর ব্যবসায় দায়িত্ব প্রদানে মোটেই ভুল করেননি। আর এই নিয়োগ লাভের ব্যাপারে জনাব আবু তালিব মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। নিয়োগ লাভর পর জনাব আবু তালিব রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এ তোমার প্রতি আল্লাহর একটি অনুগ্রহ। খাদীজার (রা) পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সংগে করে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিরিয়ার দিকে বেরিয়ে পড়লেন। যাত্রাকালে চাচারা তাঁর সহযোগীদের সতর্ক করে দিলেন তাঁর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্য। কাফিলা সিরিয়া পৌঁছলো। পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। মায়সারা গেছের একটু দূরে কোনকাজে। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে। জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘গাছের নিচে বিশ্যামরত লোকটি কে?’


মায়াসারা বলেনঃ ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রী বললেনঃ ‘এখন এ গাছের নিচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ পাদ্রী আরও জানতে চানঃ তাঁর চোখ দুইটি কি লালচে?’ মায়াসারা বললেনঃ হ্যাঁ। এই লাল আভা কখনও দূর হয় না। পাদ্রী বললেনঃ তিনি নী। তিনিই আখিরুল আম্বিয়া-শেষ নবী।


রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মায়সারাকে সংগে নিয়ে বাজারে পণ্য বিক্রি করেন। এক পর্যায়ে সেখানে এক ব্যক্তির সাথে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু বিবাদ হয়। লোকটি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেঃ আপনি লাত ও উয্যার নামে শপথ করে বলুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি তো কক্ষণও তাদের নামে শপথ করিনা। আমি তাদের প্রত্যাখ্যাত করি। লোকটি বললোঃ আপনার কথাই ঠিক। অতঃপর সে মায়সারাকে বলেঃ আল্লাহর কসম! তিনি একজন নবী।


রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদীজার (রা) বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে কোন বাজারে গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে সামান্য মতবিরোধ আছে্ একটি মতে, তিনি সিরিয়ার ‘বুসরা’ বাজার গিয়েছিলেন। আল্লাম আয-যিরিকলী ‘হাওরান’ বাজারের কথা উলে্খ করেছেন। তাবারী ইবন শিহাব যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিরিয়া নয়, বরং ইয়ামনের একটি হাবশী বাজারে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়া যাওয়ার বর্ণনাটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করলেন এবং যা কেনার তা কিনলেন। তাপর মায়সারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথে মায়সারা লক্ষ্য করলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উটের উপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দুইজন ফিরিশতা দুপুরের প্রচন্ড রোদে তাঁর মাথার উপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছেন। এভাবে মক্কায় ফিরে খাদীজার (রা) পণ্য সামগ্রী বিক্রী করলেন। ব্যবসায়ে এবার দ্বিঘুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। এই সফরে আলআহ তা’আলা মায়সারার অন্তরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রগাঢ় ভালেবাসা সৃষ্টি করে দেন। তিনি যেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাসে পরিণত হন। যখন তাঁরা মক্কার অদূরে ‘মাররুজ জাহরান’ নামক স্থানে তখন মায়সারা বলেনঃ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনি খাদীজার কাছে যান এবং আলাহ আপনার সাথে যে আচরণ করেছেনতা তাঁকে অবহিত করুন।


তাঁরা ব্যবসা থেকে মক্কায় ফিরে আসলেন। দাস মায়সারা অত্যন্ত সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে সফরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাবতীয় কর্মকান্ড, পাদ্রীর মন্তব্য, ফিরিশতার ছায়াদান, দ্বিগুণ মুনাফা ইত্যাদি বিষয়ের একটি বিস্তারিত রিপোর্ট মনিব খাদীজার ৯রা) নিকট পেশ করেন। মায়সারা একথাও বলেনঃ আমি তাঁর সাথে খেতে বসতাম। আমাদের পেট ভরে যেত, অথচ অধিকাংশ খাবার পড়ে থাকতো। এ সফরের ঘটনাবলী বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে সব বর্ণনার বিষয়বস্ত্ত এই আছে।


হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন তৎকালীন মক্কার একজন বিচক্ষণ বুদ্ধিমতী ও দৃঢ়চেতা ভদ্রমহিলা। তাঁর ধন-সম্পদ, ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মকাকর সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। তিনি ছিলেন বংমত কৌলিন্যের দিক দিয়ে কুরাইশদের মধ্যমণি। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে সহধর্মিনী হিসেবে পাওয়ার প্রত্যাশী ছিল। তাদের অনেক প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল এবং সেজন্য প্রচুর অর্থও ব্যয় করেছিল। তিনি তাঁদের সকলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। হযরত খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিয়ে করার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে সাধারণভাবে যে কথাটি বলা হয় তা হলো, বিশ্বস্ত দাস মায়সারার মুখে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নৈতিক গুণাবলী ও অলৌকিক ঘটনাবলীর কথা শুনে তিনি মুগ্ধ হন এবং বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। হয়তো এটাই মূল কারণ। তবে এর পশ্চাতে বর্ণনা করেছেন। সিরিয়া থেকে ফেরার সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চলতে চলতে এক সময় মক্কায় প্রবেশ করলেন। তখন ছির দুপুর বেলা। খাদীজা (রা) তখন তাঁর ঘরের ছাদে। তিনি সেখাকে দাঁড়িয়ে দেখলেন, মুহাম্মদ উটের উপর বসে আছেন এবয় দুইজন ফিরিশতা তাঁকে ছায়াদান করে আছে। তিনি সঙ্গের অন্য মহিলাদেরকে এ দৃশ্য দেখান। এছাড়া আর একটি ঘটনার কথা আল মাদায়িনী ইবন ‘আববাসের (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। জাহিলী যুগে মেয়েদের কোন এক উৎসব উপলক্ষে মক্কার মেয়েরা এক স্থানে সমবেত হয়। তখন দূরে এক অপরিচিত ব্যক্তি দেখা যায়। লোকটি আরও নিকটে এসে উঁচু গলায় ঘোষণা করেঃ ওহে মক্কার মহিলারা! তোমরা শুনে রাখ। খুব শিগগির তোমাদের এ মক্কা নগরীতে একজন নবীর আবির্ভাব হবে। তাঁর নাম হবে আহমাদ। তোমাদের মধ্যে যার পক্ষে সম্ভব সে যেন তাঁর স্ত্রী হয়। ইন ইসহাক বর্ণনা করেছেনঃ খাদীজা ৯রা) দাস মায়দসারার মুখে পাদ্রীর মন্তব্য ও দুইজন ফিরিশতা কর্তৃক মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়াদানের কথা শুনে ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের নিকট যেয়ে তাঁকে এসব কথা বলেন। খাদীজার কথা শুনে তিনি বলেনঃ খাদীজা! তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মুহামম্দ এই উম্মাতের নবী। আমি জেনেছি, খুব শিগগির এই উম্মাতের একজন নবী আসবেন। এ তাঁরই সময়। এরপর ওয়ারাকা প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সম্ভবতঃ উল্লেখিত সকল ঘটনা হযরত খাদীজার (রা) সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে।


এখানে ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। কারণ হযরত খাদীজার ৯রা) জীবনকে সটিক ধারায় চলমানরাখতে তাঁকে আমরা বারবার দৃশ্যপটে দেখতে পাই। ইসলামের সূচনা পর্বের ইতিহাসে সকাল বেলার সূর্যের সোনালী আভার মত তিনি ওয়ারাকা ইবন নাওফিল ইবন আসাদ ইবন ‘আবদুল ‘উয্যা। তাঁর মায়ের নাম হিন্দা বিনত আবী কাবীর। তিনি আসমানী কিতাবের ও মানুষের জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন। ত৭ার কোন সন্তানাদি ছিল না। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পূর্বেই যাঁরা তাঁর উপর ঈমান আনেন এবং মারা যান তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।


বিয়ের প্রস্তাব কিভাবে এবং কেমন করে হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা রয়েছে। তবে খাদীজাই (রা) যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কনিকট প্রস্তাবটি পেশ করেন। সে ব্যাপারে প্রায় সব বর্ণনা একমত।


একটি বর্ণনায় এসেছে, নাফীসা বিন্ত মুনইয়া বলেন, মুহাম্মদ সিরিয়া থেকে ফেরার পর তাঁর মনোভাব জানান জন্য খাদীজা (রা) আমাকে পাঠালেন। আমি তাঁকে বললামঃ মুহাম্মদ! আপনি বিয়ে করছেন না কেন? বললেন, বিয়ে করার মতো অর্থ তো আমার হাতে নেই। বললামঃ যদি আপনাকে একটি সুন্দরের প্রতি আহবান জানানো হয়, অর্থ-বিত্ত, মর্যাদা ও অভিজাত বংশের প্রস্তাব দেওয়া হয়, রাজি হবেন? বললেনঃ কে তিনি? বললামঃ খাদীজা। বললেনঃ এ আমার জন্য কিভাবে সম্ভব হতে পারে? বললামঃ সে দায়িত্ব আমার। তিনি রাজি হয়ে গেলেন।


ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন, খাদীজা ছিলেন বিচক্ষণ ও মুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি দূতের মাধ্যমে মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘হে আমার চাচাতো ভাই! আপনার বিশ্বস্ততা, সততা ও উন্নত নৈতিকতা আমাকে মুদ্ধ করেছে। সম্ভবতঃ এই দূত নাফীসা বিনত মুনইয়া।


অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, খাদীজা (রা) নিজেই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে কথা বলেন এবং তাঁর পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপনের জন্য রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, দারিদ্রে্যর কারণে হয়তো খাদীজার পিতা তাকে প্রত্যাখ্যান করবেন। অবশেষে খাদীজা নিজেই বিষয়টি তাঁর পিতার কাছে উত্থাপন করেন এবং তাঁর সম্মাতি আদায় করেন।


অনেকে এমন কথা বলেছেন যে, প্রথমখোদীজা (রা) নাফীসাকে পাঠান বিয়ের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনোভাব জানানর জন্য। তিনি ইতিবাচক সাড়া পেয়ে সরাসরি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে কথা বলেন। আর এটা সম্ভবত এ কারণে যে, তৎকালীন আরবে মেয়েদের, বিশেষত অভিজাত বংশের মেয়েদের বিয়ে-শারীর ব্যাপরে আলোচনা ও সিদ্ধান্গত গ্রহণের অধিকার ছিল। তাই পিতা অথবা চাচা জীবিত থাকতেও খাদীজা নিজেই নিজেই বিয়ের সকল পর্যায় অতিক্রম করেন।


আল-কালবী বলেনঃ খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে পাঠালেন, তিনি যেন তাঁর চাচা আমর ইবন আসাদের নিকট আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দান করেন। ‘আমার তখন থুথুড়ে বুড়ো। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)খাদীজর প্রস্তাবের কথা চাচাদের বললেন। তিনি তাঁর দুই চাচা আবু তালিব ও হাযাকে সঙ্গে করে একটি নির্দিষ্ট দিনে খাদীজার গৃহে যান। খাদীজা ছাগল জবাই করে আপ্যায়নের আয়োজন করেন। চাচা আমর ও খান্দানের লোকদেরও ডাকেন। চাচাকে পানীয় পান করান। পানাহারের পর্ব শেষ হলে খাদীজা রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আপনি আবু তালিবকে আমার চাচা ‘আমরের নিকট আমার বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করতে বলুন। অতঃপর আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করে খাদীজার সাথে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিয়ের কাজ সমাধা করেন। এই বিয়ের অল্প কিছুদিন পর খাদীজার (রা) চাচা মারা যান।


এ প্রসঙ্গে হযরত খাদীজার (রা) পিতা সম্পর্কিত কয়েকটি বর্ণনাও দেখতে পাওয়া যায়। ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে ইবন ‘আববাস (রা) থেকে বণৃনা করেছেন। খাদীজার (রা) পিতা এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। একদিন খাদীজা (রা) তাঁর গৃহে পিতার সাথে আরও কিচু কুরাইশ ব্যক্তিবর্গকে পানাহারে আমন্ত্রণ জানালেন। তারা পরিতৃপ্তি সহকারে পানাহার করে মাতাল হয়ে পড়লে খাদীজা (রা) পিতাকে বললেনঃ মুহাম্মদ আমাকে বিয়ের পয়গাম পাঠিয়েছেন। আপনি এ বিয়েতে সম্মাতি দিন। পিতা সম্মতি দান করেন। খাদীজা (রা) প্রথা অনুযায়ী পিতাকে নতুন পোশাক পরান। জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি প্রম্ন করেনঃ আমার এ নতুন পোশাক কেন? খাদীজা (রা) বলেনঃ তোমাকে আমি আবু তালিবের এই ইয়াতীমের সাথে বিয়ে দিব? আমার জীবনের শপথ! কক্ষণও তা হয় না। খাদীজা (রা) প্রতবিাদের সুরে বলেনঃ আপনি আমার ব্যাপারটি নিয়ে নিজেকে কুরাইশদের নিকট নির্বোধ প্রতিপন্ন করতে চাচ্ছেন? আপনি তাদের জানাতে চাচ্ছেন যে, আপনি মাতাল ছিলেন। খাদীজার (রা) এ কথায় তিনি সম্মতি দান করেন। আল আ’মাশ জাবির ইবন সামুরা থেকেও এ রকম কথা বর্ণনা করেছেন। ইমাম যুহরীও এরকম কথা উল্লেখ করেছেন।


আবু মিহলায বর্ণনা করেছেন। খাদীজার (রা) পিতাকে মদপান করিয়ে মাতলা করা হয়। তাপর মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডাকা হয় এবং তাঁর দ্বারা বিয়ের কাজ সমাধা করা হয়। অতঃপর প্রথা অনুযায়ী বৃদ্ধকে নতুন পোশাক পরানো হয়। সুস্থ হয়ে বৃদ্ধ প্রশ্ন করেনঃ আমার গায়ে এ নতুন পোশাক কেনৎ লোকেরা বলতোঃ এ পোশাক আপনার মেয়ের স্বামী মুহাম্মদ আপনাকে পরিয়েছেন। তিনি রাগে ফেটে পড়েন এবং হাতে অস্ত্র তুলে নেন। বনু হাশিমও প্রতিরোধের জন্য অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে যায়। শেষমেষ একটা আপোষ-মীমাংসা হয়ে যায়।


অন্য একটি সনদে এ রকম বর্ণিত হয়েছে যে, খাদীজা (রা) তাঁর পিতাকে অতিরিক্ত মদপান করিয়ে অচেতন কর ফেলেন। গরু জবেহ করেন, পিতার গায়ে রং লাগান এবং নতুন পোশাক পরান। তিনিসুস্থ হয়ে জানতে চানঃ এ গরু জবেহ কেন, আপনি আমাকে মুহাম্মাদের সাথে বিয়ে দিয়েছন, তাকি মনে নেই? তিনি বললেনঃ না, আমি তা করিনি। কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে আমি মত দিইনি। আর মুহাম্মদের সাথে আমি তোমাকে বিয়ে দিয়েছি? আমরা আগেই উল্লেক করেছি, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের সময় খাদীজার পিতা বেঁচে ছিলেন কি না সে ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতবিরোধ আছে। সুতরাং এ ব্যাপারেও মতপার্থক্য আছে যে, এ বিয়েতে খাদীজার (রা) অভিভাবক (ওয়ালী) কে হয়েছিলেন। কেউ কেউ চাচা ‘আমর ইবন আসাদের কথা বলেছেন, আবারানেকে ভাই ‘আমর ইবন খুওয়াইলিদের নাম উল্লেখ করেছেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ে দেন। কারণ ফিজার যুদ্ধের পূর্বে তাঁর পিতা মারা যান। ইবন ‘আবাবস (রা) আরও বলেনঃ ‘আমর সে সময় থুথুড়ে বুvাড়। তিনি ছাড়া আসাদের আর কোন সন্তান তখন জীবতি ছিলেন না। আর আমরেরও কোন সন্তান ছিল না। মুহাম্মদ ইবন ‘উমারও বলেছেন ফিজারের পূর্বে খাদীজার (রা) পিতা মারা যান। আর খাদীজার (রা) বিয়ের ব্যাপারে তাঁর পিতাকে জড়িয়ে যেসব বর্ণনা এসেছে সবই অসত্য ও অমূলক। তাঁর চাচাই তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ে দেন।


যাই হোক, পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষের লোকদের উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচা আবু তালিব আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের খুতবা পাঠ করেন। সংক্ষিপ্ত হলেও খুতবাটি সাহিত্য-উৎকর্ষের দিক দিয়ে জাহিলী যুগের আরবী গদ্য সাহিত্যের একটি মডেল হিসেবে চিহ্নিত। আরব ঐতিহাসিক ও সাহিত্য-রসিকরা খুতবাটি সংরক্ষণ করেছেন। পাঠকদের অবগতির জন্য আমরা তা এখানে তুলে ধরছি।


আরবি হবে


‘‘সকল প্রসংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে ইবরাহীমের বংশধর ও ইসমাঈলের ফসলের অন্তর্গত করেছেন। আমাদেরকে দান করেছেন একটি সম্মানিত শহর ও মানুষের উদ্দীষ্ট একটি গৃহ। মানুষের উপর আমাদেরকে কর্তৃত্ব দান করেছেন। মুহাম্মদ ইবন ‘আবদুল্লাহকে যে কোন কুরাইশ যুবকের সাথে পাল্লায় ওজন দেওয়া হোক না কেন, কল্যাণ মাহাত্ম্য ও ন্যায়নিষ্ঠায় তাঁর পাল্লা অবশ্যই ভারী হবে-যদিও বিত্ত-বৈভবে সে সর্বনিম্নে। তবে অর্থ-সম্মদ ক্ষণস্থায়ী ও অপসৃয়মান ছায়াস্বরূপ। খাদীজা বিনত খুওয়াইলদের প্রতি তাঁর আগ্রহ আছে এবং তার প্রতিও খাদীজার একই রকম ঝোঁক আছে। আপনারা যে পরিমাণ মাহর চান, তা আদায় করার দায়িত্ব আমার।’’


রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খাদীজার (রা) বিয়েতে দেন-মাহর কত ধার্য হয় সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য আছে। একটি বর্ণনায় এসেছে, চাচা ‘আমরের পরামর্শে পাঁচশো স্বর্ণমুদ্রা ধার্য হয়। আল-কালবী বলেনঃ মাহর নির্ধারিত হয় বারো উকিয়া স্বর্ণ। এক উকিয়া চল্লিশ দিরহারেম সমান। ইমাম জাহাবী ইবন ইসহাকের সূত্রে বলেছেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদীজাকে (রা) ‘বিল বাকরাহ’ দেন-মাহর দান করেন।


হযরত খাদীজা (রা) নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রূপো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার বন্দোবস্ত করতে বলেন।


এভাবে খাদীজা (রা) হলেন ‘উম্মুল মুমিনীন’। এ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াত প্রকাশের পনেরো বছর পূর্বের ঘটনা। অবশ্য তখন তাঁদের উভয়ের বয়স সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য আছে।


আল-কালবী ইবন ‘আববাসের (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন, নবী (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খাদীজাকে (রা) বিয়ে করেন তখন খাদীজার (রা) বয়স আটাশ (২৮) বছর। তবে বিশেষজ্ঞরা এ বর্ণনাটির সনদ দুর্বল বলে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। যুরকানী ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে বিয়ের সময় খাদীজার (রা) বয়স চল্লিশ বছর বলে উলে্খ করেছেন। ইমাম জাহবী বলেছেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স তখন পাঁচিশ এবং খাদীজা (রা) তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড়। হযরত খাদীজার (রা) ভাতিজা হাকীম ইন হিযামও এ রকম কথা বলেছেন। আল-ওয়াকিদী নাফীসা বিনত মুনইয়ার সূত্রে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স চবিবশ বছর বলে বর্ণনা করেছেন। কোন কোন বর্ণনায় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স পঁচিশ ও খাদীজার (রা) বয়স ছেচল্লিশ। তেমনিভাবে তেইশ ও আঠাশ বছরের কথাও এসেছে। সর্বাধিক সঠিক মতটি হলো পঁচিশ ও চল্লিশ।


বিয়ের পনেরো বছর পর নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াত লাভ করেন। পূর্ব তেকেই খাদীজা (রা) স্বামী মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিলেন। সহীহ বুখরীর ‘ওহীর সূচান’ অধ্যায়ে একটি হাদীসে বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। হযরত ‘আয়িশা (রা) অতি চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন।


‘‘রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তাপর নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে হিরা গুহায় চলে যেতেন। সেখানে কয়েকদিন ‘ইবাদাতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার (রা) কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমন হলো। ফিরিশতা এসে তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলের যে, তিনি কষ্ট অনুভব করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ পড়ুন। তিনি আবারও বললেনঃ আমি পড়া-লেখার লোক নই। ফিরিশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারও তাঁর সাথে প্রথম বারের মতো আচরণ করলেন। অবশেসে বললেনঃ


আরবী হবে


‘‘পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নাম। যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছে মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড থেকে। পড়ুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিছেন মানুষকে যা সে জানতো না।’’


রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন খাদীজাকে (রা) ডেকে বললেনঃ ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভীতি কেটে গেল। তিনি খাদীজার (রা) নিকিট পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশস্কার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা (রা) বললেনঃ


আরবী হবে


‘‘না, তা কক্ষণো হতে পারে না। আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বনধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী।’’


অতঃপর খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঙ্গে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহিলী যুগে তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তখন তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা (রা) বললেনঃ ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরো ঘটা বর্ণনা করলেন। সব কথা শুনে ওয়ারাকা বললেনঃ এতো সেই ‘নামূস’-আল্লাহ যাকে মূসার (আ) নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসোসা! সেদিন যদি জীবিত ও সুস্থ থাতাম, সেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে বের করে দিবে।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘এরা কি আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে?’ তিনি বললেনঃ হাঁ, তুমি যা নিয়ে আসেছো, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গেছে। যদি সে সময় পর্যনত আমার শক্তিথাকে এবং আমি বেঁচে থাকি, আমাকে সব ধরনের সাহায্য করবো।


ইমাম যুহরী বলেনঃ খাদীজা (রা) প্রথম যিনি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন। তাপর রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাত লাভ করেন। রিাসালাত লাভ করে ঘরে ফেরার পথে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছ তাঁকে সালাম জানাতে থাকে। ঘএেসে খাদীজাকে (রা) বলেন, যে সত্তাকে আমি স্বপ্নে দেখি বলে তোমাকে বলতাম, তিনি জিবরীল। প্রকাশ্রে আমাকে দেখা দিয়েছেন। আমার প্রতিপালনক তাঁকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তাপর তিনি খাদীজাকে (রা) ওহীর সকল ঘটনা খুলে বলেন। তাঁর কথা শুনে খাদীজা (রা) বলেনঃ ‘সুসংবাদ, আল্লাহ আপনার কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ করবেন না। আল্লাহর নিকট থেকে যা এসেছে তা গ্রহণকরুন। তা অবশ্যই সত্য’।


এরপর খাদীজা (রা) ছুটে যান উতবা ইবন রাবী’আর দাস ‘আদ্দাসের নিটক। তিনি ছিলেন নিনাওয়ার অধিবাসী একজন নাসারা। খাদীজা (রা) আল্লাহর নামে কসম খেয়ে ‘আদ্দাসের নিকট জানতে চানঃ জিবরীল সম্পর্কে তোমার কি কিচু জানা আছেৎ ‘আদ্দাস বললেনঃ কুদ্দুস, কুদ্দুস-পবিত্র, পবিত্র! খাদীজা (রা) বলেনঃ তুমি তাঁর সম্পর্কে যা কিছু জান আমাকে একটু বল। ‘আদ্দাস বললেনঃ জিবরীল হচ্ছেন আল্লা ও তাঁর নবীদের মধ্যের আমীন বা পরম বিশ্বাসী সত্তা। তিনি মূসা (আ) ও ঈসার (আ) নিকট এসেছেন। ‘আদ্দাসের নিকট থেউেঠে খাদীজা (রা) যান ওয়ারাকার নিটক। দুইজনের কথা শুনে তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট ফিরে আসেন।


ইবন ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ওহী লাভের পর আমি গুহা থেকে বের হলাম। আমি যখন পাহাড়ের মাঝামাঝি তখন আকাশের দিকে একটি ধ্বনি শুনতে পেলাম। কেউ যেন আমাকে বলছেঃ মুহাম্মদ আপনি আল্লাহর রাসূল। আমি মাথা উঁচু করতেই দেখলাম, একজন ধবধবে পরিষ্কার লোকের আকৃতিতে জিবরীল দাঁড়িয়ে। তাঁর দুই খানি পা মহাশূন্যের দুই দিগন্ত। তিনি আমাকে বললেনঃ মুহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরীল। আমি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতে লাগলাম। আকাশের যে দিকেই তাকালাম একই দৃশ্য দেখতে পেলাম। আমি ছাঁয় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। এদিকে আমার ফিরতে দেরী দেখে খাদীজা আমার খোঁজে লোক পাঠালেন। তাঁরা মক্কার উঁচু ভূমিতে আমাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও না পেয়ে খাদীজার নিকট ফিরে আসলো। আমি কিন্তু তখন একই স্থানে সিথর দাঁড়িয়ে।


এক সময় জিবরীল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি ঘরে ফিরে খাদীজার রান ঘেঁষে বসলাম। খাদীজা বললোঃ আবুল কাসিম! আনি কোথায় ছিলেন? আমি আপার খোঁজে লোক পাঠিয়েছিলাম। তাঁরা মক্কার উঁচু ভূমিতে খোঁজাখুজি করে কোথাও না পেয়ে ফিরে এসেছে। আমি তখন সকল ঘটনা খুলে বললাম। আমার কথা শুনে খাদীজা বললোঃ আমার চাচাতো ভাই, আপনি অটল থাকুন। খাদজীরার জীবন যাঁর হাতে, সেই সত্তার শপথ! আমি আশা করি, আপনি এই উম্মাতের নবী হবেন।’ তারপর তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়ে ওয়ারাকার নিকট চলে যান।


ইবন আববাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কার আজইয়াদ এলাকায় একাকী আছেন। তিনি দেখেন যে, একজন ফিরিশতা এক পায়ের উপর আরেকটি পা দিয়ে আকাশের দিগন্তে বসে আছেন। তিনি চেঁচিয়ে বলছেন-‘ইয়া মুহাম্মাদ! আমি জিবরীল।’ রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয় পেয়ে দ্রুত খাদীজার (রা) কাছে ফিরে এসে বললেনঃ আমার ভয় হচ্ছে, আমি কাহিন’ হয়ে না যাই। খাদীজা (রা) বললেনঃ আমার চাচাতো ভাই! আপনি এমন কথা বলবেন না। তা হতে পারে না। আনি আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখেন, সত্য বলেন, আমানত ফেরত দেন। আপনার চরিত্র তো অতি মহৎ।


আবূ মায়সারা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহী লাভের প্রথম পর্বে একাকী নির্জনে কোথাও গেলে-‘ইয়া মুহাম্মদ’ ডাক মুনতে পেতেন। তিনি ভয় পেয়ে যেতেন। একথা খাদীজাকে (রা) জানালেন। খাদীজা (রা) বললেনঃ আল্লাহ আপনার কোন অকল্যাণ করবেন না। তারপর তিনি আবু বকরের (রা) সাথে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়ারাকার নিকট পাঠিয়ে দেন।


ইমাম যুহরী থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট প্রথম ওহী লাভের পর বেশ কিছু দিন যাবত ওহী আসা বন্ধ থাকে। ইসলামের পরিভাষায় এ সময়কে ‘ফাতরাতুল ওহী’ বলে। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারুণ চিন্তাগ্রন্ত হয়ে পড়েন। তিনি হেরা গুহায় যেতে থাকেন। এ সময় একদিন জিবরীলকে উপরে দেখতে পান এবং ভীত-সন্তুস্ত হয়ে খাদীজার (রা) কাছে দুত ফিরে এসে বলেনঃ আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। খাদীজা (রা) কম্বল দিয়ে ঢেকে দেন। এ অবস্থায় নাযিল হয় সূরা আল-মুদ্দাসসির। জাবির ইবন ‘আবদিল্লাহ (রা) থেকে একই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তবে তিনি সূরা আল-মুয্যাম্মিল নাযিলের কথা বলেছেন।


খাদীজা (রা) এ সময় একদিন পরীক্ষা করতে চাইলেন। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন। খাদীজা (রা) একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমার চাচাতো ভাই! আপনার সাথী (জিবরীল আ.) যখন আপনার নিকট আসেন তখন কি আপনি আমাকে একটু জানাতে পারেন? এরপর জিবরীল যখন আসলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদীজাকে (রা) বললেন, এই জিবরীল এসেছেন। খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের ডান উরুর উপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি এখন তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন? বললেনঃ হাঁ, দেখতে পাচ্ছি। খাদীরা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাম উরুর উপর বসিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ এখন কি তাঁকে দেখা যায়ৎ বললেন হাঁ, দেখা যায়। অতঃপর খাদীজা (রা) নিজের ওড়না ফেলে দিয়ে বুক উন্মুক্ত করে ফেললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেনঃ এখনও কি তাঁকে দেখা যায়? বললেনঃ না, এমন দেখা যায় না। তখন খাদীজা (রা) বললেনঃ সুসংবাদ! আল্লাহর শপথ, তিনি অবশ্যই ফিরিশতা। কো শয়তান নয়। কারণ, এ অবস্থায় ফিরিশতা নিশ্চয় লজ্জা পাবে।


একদিন হযরত খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য আহার-সামগ্রী নিয়ে তাঁর খোঁজে মক্কার উঁচু ভূমির দিকে চলেছেন। পথে জিবরীল (আ) এক অপরিচিত ব্যক্তি রূপ ধরে আবির্ভূত হন এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। খাদীজা (রা) ভীত হয়ে পড়েন। তিনি শস্কিত হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে, না জানি লোকটি তাঁকে অপহরণ করে কিনা। পরে খাদীজা (রা) কথাটি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানালে তিনি বললেন, লোকটি ছিল জিবলীর (আ)। তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেন তোমাকে সালাম জানাই এবং জান্নাতে মণি-মুক্তোর তৈরি একটি বাড়ীর সুসংবাদ দান করি।


পূর্বে উল্লেখিত ঘটনাবলীর সবই ইসলামের অশ্যবহিত পূর্ব সময়ের ও সূচনা পর্বের। এ ধরনের আরও বহু ঘটনার কথা জানা যায় যাতে হযরত খাদীজার (রা) ধৈর্য, বিচক্ষণতা, স্বামীর প্রতি প্রবল আবেগ ও বিশ্বাস এবং সর্ব অবস্থায় স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর দৃশ্য ফুঠে উঠেছে। এ সকল ঘটনা পর্যালোচনা করলে আর যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট জিবরীলের (আ) আগমনের পূর্বেই তিনি যেন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী একজন অসাধারণ মানুষ হবেন। তিনি হবেন একজন নবী। আর তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁর কাছে এসে সর্বপ্রথম দাবী করলেন, তাঁর নিকট জিবরীল এসেছেন, তিনি ওহী লাভ করেছেন, তখন ক্ষণিকের জন্যও তাঁর মনে কোন দ্বিধা-সংশয় দেখা দেয়নি। তিনি যেন আগে থেকেই এমন একটি সংবাদ পাওয়ার জন্য পুতীক্ষায় ছিলেন, মানসিকভাবে প্রস্ত্তত ছিলেন। তাঁর সে সময়ের বিভিন্ন কর্ম ও আচরণ দ্বারা এ কথাগুলি প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়।


ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খাদীজা (রা) তাঁর সকল ধন-সম্পদ-বিত্ত-বৈভব তাবলীগে দীনের লক্ষ্যে ওয়াক্ফ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যবসা-বাণিজ্য ছেআেল্লাহর ইবাদাত এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সকল আয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে বাড়তে থাকে খাদীজার (রা) চুশ্চিন্তা। তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে সব প্রতিকূল অবস্থায় মুকাবিলা করেন। ইবন ইসহাক বলেনঃ


আরবি হবে


‘‘মুশরিকদের প্রত্যাখ্রান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদীজার (রা) দ্বারা আল্লাহ তা দূর করে দিতেন। কারণ, তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্ত্বনা দিতেন, সাহয় ও উৎসাহ যোগাতেন। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশআস করতেন। মুশরিকদের সকল অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে ইবন ইসহাক আরও বলেনঃ


আরবি হবে


‘‘রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য খাদীরা (রা) ছিলেন ইসলামের ব্যাপারে সত্য ও সঠিক উযীর। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল বিদপ-আপদে তাঁর কাছে মরেন কতা বলতেন, অভিযোগ করতেন।’’ নুবুওয়াতের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা মুসলিমদের বয়কট করে। তাঁরা ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হযরত খাদীজাও (রা) সেখানে অন্তরীণ হয়। প্রায় তিনটি বছর বনু হাশিম দারুণ অভাব ও দুর্ভিক্ষের মাঝে অতিবাহিত করে। গাছের পাতা ছাড়া জীভন ধারণের আর কোন ব্যবস্থা প্রায় তাদের ছিল না। স্বামীরাথে হযরত খাদীজা (রা) হাসিমুখে সে কষ্ট সহ্য করেন। এমন দুর্দিনে তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে নানা উপায়ে কিছু খাদ্য খাবারের ব্যবস্থা মাঝে মাঝে করতেন। তাঁর তিন ভাজিতা-হাকীম ইবন হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুম’আ ইবনুল আসওয়াদ সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে একঘরে করা মুসলিমদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।


একদিন হাকীম ইবন হিযাম চাকরে মাথার কিচু গম উঠিয়ে নিয়ে চলেছেন ফুফু খাদীজার (রা) কাছে। তনি তখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ‘শি’য়াবে আবী তালিবে’ অন্তরীণ। পথে নরাধম আবু জাহলের সাথে দেখা। সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললোঃ খাদ্য নিয়ে তুমি বনু হাশিমের কাছে যাচ্ছে? আল্লাহর কসম, এ খাদ্যসহ তুমি সেখানে যেতে পারবে না। যদি যাও, তোমাকে আমি মক্কায় লাঞ্ছিত ও অপমাণিত করবো। এমন সময় আবুল বুখতারী ইবন হাশিম সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেনঃ তোমরা ঝগড়া করছো কেন? আবু জাহল বরলোঃ সে বনু হাশিমের কাছে খাদ্য নিয়ে যাচ্ছে। আবুল বুখতারী বললেনঃ এ খাদ্য তো তার ফুফুর, হাকীমের কাছে ছিল। ফুফুর সে খাদ্য সে দতে যাচ্ছে, আর তুমি তাতে বাধ্য দিচ্ছো? পথ ছেড়ে দাও। কিন্তু আবু জাহল তাঁর কথায় কান দিল না। তখন দুই জনের মধ্যে ভালোরকম একটা মারপিট হয়। এভাবে হাকীম প্রায়ই খাদ্য পাঠাতেন।


আর একদিন হযরত ‘আববাস (রা) কিছু খাবার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ‘শি‘য়াব’ থেকে বের হলেন। আবু জাহল তাঁর হালমা করার ফন্দি আঁটে। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে রক্ষা কনের্ এ কথা খাদীজা (রা) জানতে পেয়ে চাচা যুম‘আ ইবন আল-আসাদকে লোক মারফত বলে পাঠানঃ আবু জাহল খাদ্য ক্রয়ে বাধা দিচ্ছে। তাঁকে কিছু কথা শুনিয়ে দিন। যুম‘আ খাদীজার (রা) কথামত কাজ করেন। এরপর সে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত হয়।


নামায ফরযের হুকুম হওয়ার আগেই হযরত খাদীজা (রা) ঘরের মধ্যে গোপনে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে একত্রে নামায আদায় করতেন। ইবন ইসহাক বলেনঃ একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কার উঁচু ভূমিতে তখন জিবীল (আ) আসেন এবং উপত্যকার এক প্রান্তে একটি স্থানে আঘাত করে একটি ঝর্ণার সৃষ্টি করেন। প্রথমে জিবরীল (আ) সেই পানি দিয়ে ওযু করেন, তারপর রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মত ওযু করেন। জিবরীল (আ) নামায পড়েন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর মত নামায পড়েন। তারপর রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে এসে খাদীজাকে (রা) ওযু শিখান এবং তাকে নিয়ে নামায পড়ে বাস্তব শিক্ষা দেন।


ইবন ইসহাক আরও উল্লেখ করেছেন, একদিন ‘আলি (রা) দেখতে পেলেন তাঁর দুইজন অর্থাৎ নবী (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খাদীজা (রা) নামায আদায় করছেন। ‘আলী (রা) জিজ্ঞেস করলেনঃ মুহাম্মদ, এ কি? রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন নতুন দীনের দাওয়াত ‘আলীর (রা) কাছে পেশ করলেন এবং একথা অন্য কাউকে বলতে বারণ করলেন। এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, উম্মাতে মুহাম্মাদীর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে নামায আদায়ের গৌরব অর্জন করেন।


আফীফ আল-কিন্দী নামক এক ব্যক্তি সে সময় কিছু কেনাকাটার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। তিনি হযরত ‘আববাসের (রা) গৃহে অবস্থার করছিলেন। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কা’বার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকোলো। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালো। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর এলা এক মহিলা। সেও তাদের দুই জনের পিছনে দাঁড়ালো। তারা নামায শেষ করে চলে গেল। ‘আফীফ আল কিন্দী দৃশ্যটি দেখলেন। ‘আববাসকে (রা) তিনি বললেন : বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্চে! আববাস (রা) বললেন ‘আলী এবং মহিলাটি মুহাম্মদের স্ত্রী। আমার ভাতিজার ধারণা, তার ধর্ম বিম্বপ্রতিপালকের ধর্ম। আর সে যা কিচু করে, তাঁরই হুকুরে করে। আমার জানা মতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই মাত্র এই নতুন ধর্মের অনুসারী।


হযরত খাদীজর (রা) ইনতিকালের সঠিক সন সম্পর্কে একটু মতপার্থক্য আছে। হিজতের তিন, চার অথবা পাঁচ বছর পূর্বে তিনি মক্কায় মারা যান বলে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম নববী বলেন, তিনি বছর পূর্বের কথাটি সঠিক। তাঁর মৃত্যু হয় আবু তালিবের মৃত্যুর তিনদিন পর।


বালাজুরী বলেনঃ শি‘য়বে আবু তালিব থেকে বনু হাশিম বের হয় নুবুওয়াতের দশম বছরে। এখান থেকে বের হওয়র পর সেই বছর জিলকা‘দ মাসের প্রথম দিকে অথবা শাওয়ালের মাঝামাঝি আবু তালিব মারা যান। আবু তালিব ও খাদীজার (রা) তৃুত্যর মধ্যে সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে মতভেদ আছে। যথা ৩৫,২৫, ৫ ও ৩ দিন। খাদীজার (রা) মৃত্যু হয় আগে। তাঁকে মক্কার ‘হাজূন’ গোরস্তানে দাফন করা হয়। তখন জানাযার নামাযের প্রচলন হয়নি। হযরত খাদীজার (রা) ভাতিজা হাকীম ইবন হিযাম বলেনঃ আমরা তাঁকে ঘর থেকে উঠিয়ে নিজ ‘হাজূন’-এ দাফন করি। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কবরে নামেন। তাঁর মৃত্যু হয় নুবুওয়াতের দশম বছর রমযান মাসে তখন তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি বছর। ইবনুল তাওযীও একথা বলেছেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। খাদীজা (রা) নামায ফরয হওয়ার পূর্বে ইনতিকাল করেন। আর একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁর মৃত্যু হয় রমযান মাসে, তখন তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি বছর। মক্কার উঁচু ভূমিতে অবস্থিত ‘হাজূন’ গোরস্তানে দাফন করা হয়। কাতাদা ও উরওয়া বলেছেন, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে মারা যান। আলওয়াকিদী বলেছেনঃ বনু হাশিমের উপত্যকা থেকেতাঁরা মুক্ত হন হিজরাতের তিন বছর পূর্বে। তাপর আবু তালিব মারা যান। দুই জনের মৃত্যু হয় একই বছর। তবে আবু তালিবের মৃত্যুর তিন দিন পর খাদীজার (রা) মৃত্যু হয়। ইমাম আয-যাহাবী বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের সময় খাদীজার (রা) বয়স ছিল ৪০ বছর তাঁর সাথে জীভন কাটান ২৪ বছর। এই হিসাবে তিনি ৬৪ বছর জীবন লাভ করেন।


পরম শ্রদ্ধেয় চাচ আবু তালিব ও প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার (রা) ওফাতের পর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। আর তা ছিল সর্বাধিক কঠিন অধ্যায়। হযরত রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই তাঁদের ওফারেত বছরকে ‘আমুল হুযন’-দুঃখ ও শোকের বছর নামে অভিহিত করতেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতিপ্রিয় এ দুই ব্যক্তির মৃত্যুতে কুরাইশ পাষন্ডরা একেবারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা অতি নির্দয়ভাবে থাকে। এ সমই তিনি মক্কাবাসীদের প্রতি হতাশ হয়ে তায়েফ গমন করেন। খাদীজা (রা) জীবিত থাকলে তিনি অন্তত জিনের দুঃখের কথা তাঁকে বলতে পারতেন। ইবন ইসহাক বলেছেনঃ খাদীজার (রা) তিরোধানের পর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর একের পর এক মুসীবত আসতেই থাকে। কারণ, পৌত্তলিক শক্তিকে রুখতে পারে, আবু তালিব ও খাদীজার (রা) মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তখন আর ছিলেন না।


ইবনুল আসীর বলেনঃ


আরবী হবে


‘‘এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মার ইজমা’ হয়েছে যে, হযরত খাদীজা (রা) আল্লাহর সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলিম হয়েছে।’’


যুহরী, কাতাদা, মূসা ইবন ‘উকবা, ইবন ইসহাক, আল-ওয়াকিদী ও সা‘ঈদ ইবন ইয়াহইয়া বলেছেনঃ


আরবি হবে


‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর সর্বপ্রথম ঈমান আনেন খাদীজা, আবু বকর ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম।’’


হযরত হুজাইফা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন :


আরবি হবে


‘‘আল্লাহ ও মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে খাদীজা (রা) বিশ্বের সকল নারীর অগ্রবর্তিনী।’’


সা‘ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেছেনঃ


আরবি হবে


-‘নারীদের মধ্যে খাদীজা (রা) প্রথম মুসলিম।’


ইমাম নববী বলেনঃ যুহরী ও ‘আলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দল উল্লেখ করেছেন যে, খাদীজা (রা) আল্লাহ ও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান আনেন। আর এ কথার উপর ইজমা’ হয়েছে বলে ইমাম সা‘লাবী বর্ণনা করেছেন। ইসলাম গ্রহণের সময় হযরত খাদীজার (রা) বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর পিতৃকূলের লোকদের উপরও পড়েছিল। ইসলামের আবির্ভাবের সময় পিতৃকূল বনু আসাদ ইবন ‘আবদিল ‘উযযার পনেরো জন বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। তাঁদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। অন্য পাঁটজন কাফির অবস্থায় বদর যুদ্ধে নিহত হয়।


হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন বহু সন্তানের জননী। প্রথম স্বামী আবু হালার ঔরসে হালা ও হিন্দ নামে দুই ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হিন্দ বদর, মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে অংশগ্রহণ করেন। তবে বালুজাুরীর বর্ণনায় বুঝা যায়, প্রথম স্বামীর ঘরে একটি মাত্র ছেলে ছিল, তাঁর নাম হিন্দ। পিতার নামে নাম রাখা হয়। তিনি ছিলেন একজন প্রাঞ্চলভাষী বাগ্মী পুরুষ। উটের যুদ্ধে তিনি ‘আলীর (রা) পক্ষে শাহাদাত বরণ করেন। দ্বিতীয় সআবমী ‘আতীকের ঔরসে হিন্দা নাম্মী এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইসলাম গ্রহণকরে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। অবশ্য একটি বর্ণনা মতে প্রথম পক্ষেতাঁর তিনটি সন্তান জন্মলাভ করে দুই ছেলে হিন্দা ও হারিস। হারিসকে এক কাফির ক‘বার রুকনে ইয়ামানীর নিকট শহীদ করে ফেলে। এক কন্যা যায়নাব। আর দ্বিতীয় পক্ষের মেয়েটির ডাকনাম ছিল উম্মু মুহাম্মদ। তার বিয়ে হয় সায়ফী ইবন উমাইয়্যার সাথে। মুহাম্মাদ নামেতাঁর এক ছেলে হয়। এ কারণে তাঁকে উম্মু মুহাম্মদ নামে ডাকা হতো।


ইবন ইসহাক বলেন, একমাত্র ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল সন্তান হযরত খাদীজার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেনঃ আল-কাসিম, আত-তায়্যিব, যায়নাব, রুকাইয়া, উম্ম কুলসুম ও ফাতিমা (রা)। ইবন হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বড় ছেলে আল কাসিম। তারপর আত-তায়্যিব ও আত-তাহির। বড় মেয়ে রুকাইয়া, তারপর যায়নাব, উম্মু কুলসুম ও ফাতিমা (রা)।


ইবন ইসহাক আরও বলেন, আল-কাসিম, আত-তায়্যিব ও আত-তাহির জাহিলী যুগেই মারা যান। আর মেয়েদের সকলে ইসলামী যুগ লা করেন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে মদীনায় হিজরাত করেন।


ইবন ইসহাক ও ইবন হিশামের বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, আত-তাহির ও আত-তায়্যিব ভিন্নুই ছেলে। অথচ এ দুইটি নাম রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছেলে হযরত ‘আবদুল্লাহর দুইটি লকব বা উপাধি। আল ওয়াকিদী বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে হযরত খাদীজার (রা) আল কাসিম ও ‘আবদুল্লাহ নারে দুই ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। নুবুওয়াত লাভের পর ‘আবদুল্লাহর জন্ম হয় বলে তাঁকে আত-তাহির বলা হতো। এছাড়া চার মেয়েও জন্মগ্রহণকরেন। মোট ছয় সন্তানের মা হয়। প্রথম সন্তান আল-কাসিম। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে দুগ্ধপোষ্য বয়সে মক্কায় মারা যান। তাঁর নাম অনুসারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুনিয়াত বা উপনাম হয় আবুল কাসিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি পা পা করে হাঁটা শিখেছিলেন। বালাজুরীর মতে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র দুই বছর।


ইমাম আস-সুহাইলী বর্ণনা করেছেন, আল-কাসিম মারা যাওয়ার পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদীজার (রা) কাছে যান। তিনিকাঁদতে বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লুহ! আমার দুধের টুকরো মারা গেছে। যদি সে দুধ পান শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকতো তাহলে আমার দুঃখ ছিল না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেনঃ তুমি চাইলে জান্নাতের মধ্য থেকে তার কণ্ঠস্বর তোমাকে শোনাতে পারবো। খাদীজা (রা) বলেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশি ভালো জানেরন। এই বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় আল-কাসিমের মৃত্যু জাহিলী যুগে নয়, বরং ইসলামী যুগে হয়েছে।


দ্বিতীয় সন্তান হযরত যায়নাব (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বড় মেয়ে। খালাতো ভাই আবুল আস ইবন রাবী‘র সাথে বিয়ে হয়। আবুল ‘আসের মা হালা বিনত খুওয়াইলিদ।


তৃতীয় সন্তান হযরত ‘আবদুল্লাহ। তাঁকেই আত-তায়্যিব ও আত-তাহির বলা হয়। যেহেতু নুবুওয়াত লাভের পর ত৭ার জন্ম হয়, তাই এ নামে আখ্যায়িত করা হয়। শিশু বয়সে মক্কায় ইনতিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কাফিররা, বিশেষতঃ ‘আস ইবন ওয়ায়িল রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আবতাব’ বা নির্বংশ বলে উপহাস করতে থাকে। তখন নাযিল হয সূরা আল কাওসার-এর এ আয়াতঃ


আরবী হবে


-যে আপনার শত্রু, সে-ই লেজকাটা, নির্বংশ।


অবশ্য এ ব্যাপারে প্রথম সন্তানের মৃত্যুর কথাও বর্ণিত হয়েছে। চতুর্থ সন্তান হযরত রুকাইয়া (রা)। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় উতবা ইবনআবী লাহাবের সাথে। ইসলামের সাথে চরম দুশমনীর কারণে সে হযরত রুকাইয়াকে তালাক দেয়। তাপর হযরত ‘উসমানের (রা) সাথে বিয়ে হয়। হিজরাতের পর মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় ইনতিকাল করেন। পঞ্চম সন্তান হযরত উম্মু কুলসুম (রা)। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় মু‘আত্তাব, মতান্তরে ‘উতাইবা ইবন আবী লাহাবের সাথে। সেও প্রবল ইসলাম বিদ্বেষের কারণে স্ত্রী উম্মু কুলসুমকে তালাক দেয়। তারপর বোন রুকাইয়ার মৃত্যুর পর হযরত ‘উসমানের (রা) সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এ কারণে হযরত ‘উসমানের (রা) উপাধি হয় ‘জিন-নূরাইন’।


ষষ্ঠ সন্তান হযরত ফাতিমা (রা) চতুর্থ খলীফা হযরত ‘আলীর (রা) স্ত্রী এবঙ হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইনের (রা) মা।


উল্লেখ্য যে, ইবরাহীম ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাসী হযরত মারিয়া আল কিবতিয়ার (রা) গর্ভজাত সন্তা। এই মারিয়াকে মিসরের শাসক ‘মাকাওকাস’ উপহার হিসেবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট পাঠান। মোটকথা, একমাত্র ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল সন্তানের জননী হলেন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)।


হযরত খাদীজা (রা) সন্তানদের খুব আদর যত্ম করতেন। আর্থিক সচ্ছলতাও ছির সন্তানদের প্রতিপালন ও দুধ পানকরানোর জন্য ধাত্রী নেয়াগ করতেন। সন্তান প্রসবের আগেই সব ব্যবস্থা করে রাখতেন। সাফিয়্যার দাসী সালামাকে মজুরীর বিনিময়ে সন্তানদের দেখাশুনার জন্য নিয়োগ করেন। সালামা তাদেরকে দুধপান ও আহার করাতেন।


হযরত খাদীজা (রা) যে তাঁর সকল সন্তানকে কী পরিমাণ ভালোবাসতেন এবং তাদের মঙ্গল কামনায় কেমন অস্থির থাকতেন, একটি বর্ণনায় তা কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেঠে। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশ্ন করলেনঃ ইহা রাসূলাল্লাহ! আপনার ঔরসে আমার যে সকল সন্তান হয়েছে এবং শিশু অবস্থায় মারা গেছে পরকালে তাদের অবস্থান কোথায় হবে? বললেনঃ জান্নাতে। তিনি আবার জানতে চাইলেনঃ আমার পৌত্তলিক স্বামীদে ঔরসে যে সন্তান হয়েছে এবং মারা গেছে, তারা কোথায় যাবে? বললেনঃ জাহান্নামে। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ কোন রকম কর্ম ছাড়াই? বললেনঃ আল্লাহ জানেন বেঁচে থাকলে কেমন কর্ম তারা হয়তো। এ বর্ণনায় সন্তানদের জন্য তাঁর আকুলতা তা প্রকাশ পেয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার (রা) ফলীলাত, মহাত্ম্য ও মর্যাদা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমরা অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করি, আরবের সেই ঘোর অন্ধকার দিনে কিভাবে এক মহিলা সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন চিত্তে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করছেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয় নেই। নেই ওহী লাভের প্রথম দিনটি, ওয়ারাকার নিকট গমন এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হওয়া সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা সবকিছুই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।


রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকে খাদীজা (রা) যেন দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন-তিনি নবী হবেন। তাই জিবরীলের (আ) আগমনের পর ক্ষণিকের জন্যও তাঁর মনে একটুও ইতস্তাতঃ ভাব দেখা দেয়নি। এতে তাঁর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নুবুওয়াত লাভের আগে ও পরে সর্বদাই তিনি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করেছেন। পাঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে কোন প্রকার সন্দেহ দানা বাঁধতে পারেনি। সেই জাহিলী যুগেও তিনি ছিলেন পুতঃপবিত্র। কখনও মূর্তি পূজা করেননি। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন তাঁকে বললেনঃ ‘আমি কখনও লাত-‘উযযার ইবাবাদ করবো না।’ খাদীজা (রা) বললেনঃ লাত-‘উযযার প্রসঙ্গ ছেড়ে দিন। তাদের কথাই উঠাবেন না।


নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারিণী এবং তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারিণীই শুধু তিনি নন। সেই ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন চিরদিন তা অম্লান হয়ে থাকবে। ইসলামের সেই সূচনা লগ্নে প্রকৃতপক্ষেই তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরামর্শদাত্রী। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের পর নিজের সমস্ত সম্পদ তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। যায়িদ ইবন হারিসা (রা) ছিলেন খাদিজার (রা) প্রিয় দাস। তাকেও তিনি স্বামীকে উপহার দেন।


ইবন হিশাম বলেনঃ খাদীজার (রা) ভাতিজা হাকীম ইবন হিযাম সিরিয়ার বাজার থেকে অনেকগুলো দাস কিনে আনেন। তাদের মধ্যে যায়িদ ইবন হারিসাও একজন। ফুফু খাদীজা গেলেন ভাতিজা হাকীমের সাথে দেখা করতে। ভাতিজা বললেনঃ ফুফু, এ দাসগুলির মধ্যে যেটি পছন্দ হয়, আপনি বেছে নিন। খাদীজা (রা) যায়িদকে পছন্দ করে নিয়ে আসেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যায়িদকে দেখে পছন্দ করেন। খাদীজা (রা) তা বুঝতে পেরে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপহার দেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে পালিত পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।


অপর একটি বর্ণনায় এসেছে; হাকীম তাঁর ফুফু খাদীজার (রা) জন্য যায়িদকে (রা) আরবের ‘উকাজ মেলা থেকে কিনে আনেন। আর এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খাদীজার (রা) পণ্য নিয়ে মায়সারার সাথে সিরিয়া যান, সেই সফরে যায়িদকে খাদীজার (রা) জন্য কিনে আনেন। বিয়ের পর খাদিজা (রা) যায়িদকে উপহার হিসেবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে তুলে দেন।


হযরত খাদীজা (রা) স্বামী রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গভীরভাবে ভালোবাসতেন। স্বামীর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদেরকেও সম্মান করতেন, খোঁজ খবর নিতেন এবং তাঁদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়াতেন। একবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুধমাতা হালীমা আসলেন দেখা করতে। খাদীজা (রা) আপন শাশুড়ীর মত মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে তার সেবা-যত্ম করলেন। হালীমা রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাঁদের অঞ্চলে খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে পশু-পাখমিারা গেছে এবং অভাব দেখা দিয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের সমস্যা নিয়ে হযরত খাদীজার (রা) সাথে কথা বললেন। খাদীজা (রা) হালীমাকে চল্লিশটি ছাগল ও উট দান করলেন তাঁর খান্দানের মধ্যে বণ্টনের জন।


আবু লাহাবের দাসী সুওয়ায়বা ছিলেন রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর এক দুধমাতা। তিনি মাঝে মাঝে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট আসতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রতি সম্মান দেখাতেন, এবং তাঁর সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। খাদীজাও (রা) তাঁকে খুবই সম্মান ও সমাদয় করতেন। তিনি সুওয়ায়বাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দানের উদ্দেশ্যে আবু লাহাবের নিকট তাঁকে কেনার প্রস্তাব করেন; কিন্তু সে বিক্রী করতে রাজি হয়নি।


মক্কার একজন বিত্তশালী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও নিজ হাতে স্বামীর সেবা করতেন। সন্তানদের প্রতিপালনসহ গৃহকর্মের যাবতীয় দায়িত্ব নিজ পালন করতেন। স্বামীর আহার, বিশ্রাম ইত্যাদির তদারক নিজে করতেন হযরত আবু হুরাইরার (রা) একটি হাদীসে এসেছে, তিনি বলেনঃ


আরবী হবে


-একদিন জিবরীল (আ) নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এসে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই যে খাদীজা আসছেন পাত্রে করে আপনার জন্য তরকারি, খাদ্যসামগ্রী অথবা পানীয় কিচু নিয়ে আপনি তাঁর রব ও আমার পক্ষ থেকে তাঁকে সালাম বলবেন এবং জান্নাতে মণি-মুক্তার তৈরি একটি বাড়ীর সুসংবাদ দান করবেন।


এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘর-গৃহস্থালীর যাবতীয় দায়িত্ব অন্যের উপর ছেড়ে না দিয়ে নিজই সম্পন্ন করতেন।


হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খাদীজাকে (রা) গভীরভাবে ভালোবাসতেন। খাদীজার (রা) মৃত্যুর পরও আজীবন তাঁর স্মৃতি ও তাঁর অবদান মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়নি। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বহু আচরণ এবং বহু মন্তব্যে তা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ


আরবী হবে


-আমি খাদীজাকে (রা) দেখিনি। তা সত্ত্বেও তাঁকে যে পরিমাণ ঈর্ষা করতাম, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য কোন স্ত্রীকে সে পরিমাণ ঈর্ষা করিনি। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব বেশি বেশি তাঁকে স্মারণ করতেন। তিনি যখনই কোন ছাগল জবেহ করতেন, তার কিচু অংশ কেটে খাদীজার বান্ধবীদের কাছে পাঠাতেন। আমি যদি বলতাম, দুনিয়াতে যেন খাদীজা ছাড়া আর কোন নারী নেই। তিনি বলতেন, খাদীজা এমন ছিল। তাঁর থেকেই আমি সন্তান লাভ করেছি।


‘আয়িশা (রা) আরও বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার খাদীজার কথা আলোচনা করলেন। আমি একটু কটূক্তি করে বললামঃ তিনি তো একজন বৃদ্ধা। তাছাড়া এমন, এমন। আল্লাহ তাঁর পরিবত©র্ উত্তম নারী আপনাকে দান করেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তাঁর চেয়ে উত্তম নারী আমাকে দান কনেনি। মানুষ যখন আমাকে মানতে অস্বীকার করেছে, তখন সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে। মানুষ যখন বঞ্চিত করেছে, তখন সে তার স্মপদে আমাকে অংশীদার করেছে। আল্লা তার সন্তান আমাকে দান করেছেন এবং অন্যদের সন্তান থেকে বঞ্চিত করেছেন।আমি বললামঃ আমি আর কক্ষণও তাঁকে নিয়ে আপনাকে তিরস্কার করবো না।


আরেকটি বর্ণনায় এসেছে। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ খাদীজার মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গৃহে কোন ছাগল জবেহ হলেই বলতেনঃ কিছু গোশত তোমরা খাদীজার বান্ধবীদের বাড়ীতে পাঠাও। একদিন তিনি খাদীজার আরোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ আমি খাদীজার বান্ধবীদের ভালোবাসি। ‘আয়িশা (রা) আরও বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদীজার কথা উঠলেই তাঁর কিচু প্রশংসা নাকরে বিরত হতেন না। তিনি খাদীজার কিছু আলাচনা না করে প্রতিদিন ঘর থেকে বরে হতেন না। আর একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখে খাদীজার (রা) আলোচনা শুনে ‘আয়িশা (রা) অনুতপ্ত হয়ে মনে মনে বলেনঃ হে আল্লাহ, যদি তুমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগ দূর করেন দাও, তাহলে আর কক্ষণও ত৭ার সম্পর্কে কোন মন্দ কথা উচ্চারণ করবো না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে বললেনঃ তুমি এমন কথা কি করে বলতে পারৎ মানুষ যখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তখন সে আশ্রয় দিয়েছে। আরেকবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে (রা) বলেনঃ আল্লাহ আমার অন্তরে তাঁর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছন।’


আবুল ‘আস ইবনুর রাবী’ মক্কার একজন সৎ বিশ্বস্ত ও বিত্তবান ব্যবসায়ী যুবক। খাদীজার (রা) বোন হালা বিনত খুওয়াইলিদের ছেলে। খালা খাদীজা (রা) তাঁকে নিজের ছেরেন মতই দেখতেন। তিনি নেজের মেয়ে হযরত যায়নাবের (রা) সাথে আবুল আসের বিয়ে দিতে চাইলেন। রাসূর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অমত করলেন না। বিয়ে হলে গেল। বিয়ের সময় হযরত খাদীজা (রা) মমেয়ে যায়নাবকে (রা) যে সখল নজিস উপহার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি সোনার হার ছিল।


রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াত লাভ করলেন। খাদীজার (রা) কন্যারা মুসলমান হলেন। কিন্তু আবূল ‘আস অমুসলিমই থেকে গেলেন। খাদীজা (রা) দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরত করলেন। মেয়ে যায়নাব (রা) মক্কায় স্বামীর কাছে থেকে গেলেন। আবুল ‘আস মক্কায় কুরাইশদের সাথে বদরে গেলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বন্দী হয়ে তিনি মদীনায় শ্বশুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট পৌঁছলেন। মুক্তিপণের বিনিময়ে যুদধবন্দীদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত হলো। ন্দীদের আপনজনেরা মক্কা থেকে মুক্তিপণের অর্থ পাঠালো। যায়নাব (রা) স্বামীর মুক্তিপণ বাবদ যে অর্থ সম্পদ পাঠালেন তার মধ্যে একটি সোনার হার ছিল। মূলতঃ সেটি ছির মা খাদীজার (রা) দেওয়া বিয়ের হারটি। হারটি দেখে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনটি ব্যথা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো। তাঁর মানসপটে ভেসে উঠলো খাদীজার (রা) স্মৃতি। তিনি সাহাবীদের বললেনঃ তোমরা পারলে যায়নাবের বন্দীকে ছেড়ে দাও এবঙ অর্থও ফেরত দাও। সাহাবীরা রাজি হলেন। তাঁরা কোন মুক্তিপণ ছাড়াই আবুল ‘আসকে মুক্তি দিলেন।


হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ


আরবি হবে


-খাদীজার (রা) বোন হালা বিনত দওয়াইলিদ একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অনুমতি চাইলেন। (দুই বোনের গলার স্বর ও অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গি একই রকম ছিল বলে) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদীজার (রা) অনুমতি চাওয়ার কথা মনে করে হতচকিত হয়ে ওঠেন। তারপর (স্বাভাবিক হয়ে) তিনি বলে উঠরেনঃ ইয়া আল্লাহ! এ তো দেখছি হালা। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ এতে আমার ভাবী ঈর্ষা হলো। আমি বললামঃ কুরাইশ বুড়ীদের এক লাল গালের বুড়ী, যে শেষ হয়ে গেছে কতকাল আগে, তার আবার কি স্মরণ করেন। আল্লাহ তো তার চাইতেও উত্তম স্ত্রী দান করেছেন।


মুহাম্মদ ইবন সালামা থেকে বর্ণিত হয়েছে। হযরত খাদীজার (রা) ইনতিকালের পর হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত শোকাতুর হয়ে পড়েন যে তাঁর জীবন-আস্কা দেখা দেয়। অবশেষে তিনি ‘আয়িশাকে (রা) বিয়ে করেন।


হযরত খাদীজার (রা) ফযীলাত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বহু বাণী ও মন্তব্য হাদীসে ও সীরাতের গ্রন্থবলীতে পাওয়া যায়। আমাদের পূর্বের আলোচনায় তার কিচু পেশ করছি। এখানে আরও কয়েকটি বাণী তুলে ধরছি।


হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ


আরবী হবে


 বিশ্বের নারীদের মধ্যে তোমাদের জন্য চারজনই যথেষ্ট।


আনাস (রা) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ


আরবী হবে


-বিশ্বের নারী জাতির মধ্যে সর্বোত্তম হলেনঃ মারইয়াম, আসিয়া, খাদীজা বিনত খুওয়াইলদ ও ফাতিমা (রা)।


‘আলী (রা) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছিঃ


আরবি হবে


-খাদীজা বিনত খুওয়াইলিদ তাঁর সময়ের সর্বোত্তম নারী। মারইয়াম বিনত ইমরাত তাঁর সময়ের সর্বোাত্তম নারী।


‘আবদুল্লাহ ইবনুল ‘আববাস (রা) থেকে বর্নিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ


আরবী হবে


মারইয়াম বিনত ইমরানের পরে ফাতিমা, খাদীজা ও ফির‘আউনের স্ত্রী আসিয়া জান্নাতের অধিবাসী মহিলাদের নেত্রী।


‘আবদুল্লাহ ইবনুল আববাস (রা) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীসে এসেছেঃ জান্নাতের অধিকারী নারীদের মধ্যে খাদীজা, ফাতিমা, মারইয়াম ও আসিয়া সর্বোত্তম। ইমাম নাসাঈ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বহুবার বলতে শুনেছিঃ


আরবী হবে


-খাদীজা (রা) জগতের সর্বোত্তম নারী।


ইমাম আয-যাহাবী হযরত খাদীজার (রা) স্থান ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ তাঁর ফযীলাত অনেক। তাঁর সময়ের বিশ্বের সকল নারীর নেত্রী। যে সকল নারী (বিদ্রঅ, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায়) পূর্ণতা লাভ করেছেন, তিনি তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমতী, অতি সম্মাণিতা, ধর্মপরায়ণা, নিস্কলুষ চরিত্রের অধকারিণী এক ভদ্রমহিলা। তিজিান্নাতের অধিকারিণী। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং অন্য বিবিগণের উপর তাঁর প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তাঁর প্রতি অতিমাত্রায় সম্মান প্রদর্শন করেছেন। তিনি তাঁর পূর্বে এবং তাঁর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধিক সন্তানের জননী। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বোত্তম জীবন সঙ্গিনী। তাঁকে হারিয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন। নিজের ধন-সম্পদ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য ব্যয় করেছেন, আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। আল্লাহ পাকতাঁর নবীর মাধ্যমে তাঁকে জান্নাতের মণি-মুক্তার তৈরি একটি বাড়ীর সুসংবাদ দান করেছেন।


অনেকগুলি সূত্রে একথা বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ হে খাদীজা, জিবরীল তোমাকে সালাম জানিয়েছেন।’ তাঁর মধ্যে কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, জিবরীল বলেন, ‘হে মুহাম্মদ আপনি আপনার রব ও আমার পক্ষ থেকে খাদীজাকে সালাম বলুন।’ জবাবে খাদীজা বলেনঃ


আরবী হবে


হযরত আনাসের (রা) একটি বর্ণনায় হযরত খাদীজার (রা) জাবাবটি এসেছে এ রকমঃ


আরবী হবে


হযরত খাদীজা (রা) নবী মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বামী হিসেবে গ্রহণকরে, অটল হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে এবং নিজর সবকিছু তাঁর হাতে তুলে দিয়ে মানব জাতির অপার কল্যাণ সাধনকরে গেছেন। তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করে আমরা শেষ করতে পারবো না। আল্লাহ পাক ও জিবরীলের (আ) মত আমরাও তাঁর প্রতি অগণিত বার সালাম পেশ করে আমাদের কথার সমাপ্তি টানছি।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ইসলামিক গল্পের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url