আমরা যখন প্রথম লিখতে শুরু করি, তখন আমাদের জিভের ডগায় নাচত কয়েকটি নাম—শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন, আবু রুশদ, গোলাম কুদ্দুস, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং শামসুদ্দীন আবুল কালাম। আমাদের এই জগদ্দল সমাজে লেখক হওয়ার যে কী মানে, তা আমি কাগজে-কলম ছুঁইয়েই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই, আমাদের সমাজের এই অগ্রগণ্য লেখকদের সাহিত্যচর্চা বরাবরই আমার কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ঠেকেছে। তাদের সাহিত্য ফসলের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞবোধ করেছি সব সময়। তাই, আমাদের আড্ডায় বার বার ঘুরে-ফিরে উচ্চারিত হতো এ কয়েকটি নাম, উচ্চারিত হতো তাদের রচিত কত পঙিক্ত।
আমাদের বরণীয় এই আটজন লেখকের মধ্যে দুজন লোকান্তরিত হয়েছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মারা গেছেন প্যারিসে, ফররুখ আহমদ ইন্তেকাল করেছেন আমাদের এই চিরচেনা ঢাকা শহরে। তিনি মারা গেছেন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায়। না, ভুল বললাম। নিঃস্ব কথাটা তার সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। তার মানসিক ঐশ্বর্যের কোনো কমতি ছিল না। তিনি রেখে গেছেন এমন কয়েকটি গ্রন্থ যেগুলো পঠিত হবে দীর্ঘকাল। তার বহু পঙিক্ত বার বার গুঞ্জরিত হবে কাব্যপিপাসুদের স্মৃতিতে। যে কবিতা তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেলেন তা তার স্মৃতিকে চিরদিন পাঠকদের মনে উজ্জ্বল করে রাখবে সত্য, কিন্তু কবিতা তাকে দেয়নি সচ্ছলতা, তার পরিবারকে দেয়নি কোনো নিরাপত্তা। সারা জীবন তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গেই ঘর করেছেন, জাহান্নামে বসেই হেসেছেন পুষ্পের হাসি। দারিদ্র্য তার শরীরকে ক্ষইয়ে দিয়েছিল ভীষণভাবে, কিন্তু কখনো কামড় বসাতে পারেনি তার মনের ওপর।
তার মতো অসামান্য কবি খুবই সামান্য একটা চাকরি করতেন। মাইনে পেতেন মাত্র ছ’-সাতশ’ টাকা অথচ তার ঘরে বারো-তেরোজন পুষ্যি। আজকের দিনে এই ক’টি টাকায় কী করে চালানো সম্ভব এত বড় সংসার? ফররুখ আহমদের কাব্যের সংসার যত জেল্লাদারই হোক না কেন, তার সংসার বরাবরই খুব নিষ্প্রভ। দারিদ্র্য ম্লান করে দিয়েছিল তার সংসারের মুখ। পয়সা কামানোর দিকে কখনো মন ছিল না তার। পারলে তিনি হয়তো চাকরিও করতেন না কখনো। ধরা-বাঁধা চাকরি করার মানসিকতা তার ছিল না। তিনি ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তাই, যখন তাকে রেডিও অফিসে দেখতাম একজন সামান্য চাকুরে হিসেবে, আমার কেমন যেন খটকা লাগত। সেখানে বড় বেমানান লাগত ফররুখ আহমদকে।
অনেক বছর আগেকার কথা। আমিও তখন রেডিওতে চাকরি করি। আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন দুটি বছর আমি কাটিয়েছিলাম রেডিওতে। কিন্তু আমার সেই কর্মজীবনের একমাত্র আনন্দ ছিল ফররুখ আহমদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া। মতাদর্শের দিক থেকে আমরা দুজন অবস্থান করতাম দুই বিপরীত মেরুতে। আমি জানতাম তার ঝাঁজালো রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা, তার অসিহষ্ণুতার কথা—কিন্তু এর কোনোটাই সে সময় আমার আর তার সম্পর্কের সঙ্গে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনিও ভালো করেই জানতেন আমার বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের কথা, আমার রাজনৈতিক মতামতের কথা। তার সঙ্গে কখনো আমার কোনো রাজনৈতিক সংলাপ হয়নি।
তিনি এড়িয়ে যেতেন, আমিও তাকে রাজনৈতিক তর্ক জুড়তে প্ররোচিত করিনি কোনো দিন। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেতে থাকতাম সাহিত্যালোচনায়। বিশেষ করে, কবিতার কথা বলতে ভালোবাসতেন তিনি। বিভিন্ন কবির পঙিক্তমালা তিনি আবৃত্তি করতেন, তার দীর্ঘ এলোমেলো চুল নেমে আসত কপালে, ধারালো উজ্জ্বল চোখ হয়ে উঠত উজ্জ্বলতর। তার আরেকটি প্রিয় প্রসঙ্গ ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা। মধুসূদনের কথা বলতে গেলেই তার কণ্ঠে বেজে উঠত অন্যরকম সুর। মধুসূদনের কবিতা অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারতেন তিনি। তার মৃত্যু-সংবাদ শুনে ছুটে গিয়েছিলাম কবির ফ্ল্যাটে। যে ফররুখ আহমদকে আমি বহুদিন বসে থাকতে দেখেছি আজিজিয়া রেস্টুরেন্টে, যে ফররুখ আহমদের সঙ্গে রেডিওর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়েছি, যে ফররুখ আহমদের সঙ্গে রমনার বৃক্ষ চূড়াময় পথে হেঁটেছি বহুদিন, যে ফররুখ আহমদের সঙ্গে কথা বলেছি দিনের পর দিন, যে ফররুখ আহমদকে কাজের ক্লান্তির মধ্যে কোনো দিন এতটুকু ঝিমুতে দেখিনি, সেই ফররুখ আহমদকেই দেখলাম তার নিভৃত শয্যায়। তাকে দেখলাম, নির্বাক, নিথর। কী আশ্চর্য, তিনি একবারও হাসিমুখে তাকালেন না আমার দিকে, বললেন না, কি চলবে নাকি এক পেয়ালা? না তিনি এই প্রথমবারের মতো আমাকে চা খেতে অনুরোধ করলেন না। অথচ তার কাছে চা না-খাওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। আমি অন্তত এমন একটি দিনের কথাও মনে করতে পারি না যে, আবুল মিয়ার দোকানে গিয়ে ফররুখ আহমদের পাশে বসেছি এবং চা ও নিমকি খাইনি। চা না খাইয়ে তিনি ছাড়তেন না। কোনো ওজর-আপত্তি তিনি শুনতেন না। ‘আরে খাও খাও, কিসসু হবে না, বলতেন সেই দরাজদিল মানুষটি। SEE MORE…………..